Written by Mousumi Das
বাংলা সাহিত্যের জগৎটা অনেকটাই বড়। যে ভাষাকে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কালজয়ী লেখক যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু এবং পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবীর মতো লেখক লেখিকারা পৃথিবীর দোড় গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। তবে প্রথমেই তাদের লেখা দিয়ে তোমার বাংলা বই পড়ার যাত্রা শুরু করলে হয়তো একটু হোঁচট খেতে পারো। তাদের লেখার গভীরতা বুঝতে তোমাকে একটু সহজ লেখা দিয়ে পড়া শুরু করতে হবে। তবেই আসতে আসতে লেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত অর্থ, আবেগ, বিরহ, বিলাস এসব অনুভূতি তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে।
যদি তুমি বাংলা ভাষা শিখতে চাও বা দীর্ঘদিন পরে আবার বাংলা বই পড়া শুরু করছো তাহলে নিচের এই পাঁচটি বই হতে পারে আদর্শ সূচনা। প্রতিটি বই-ই একেবারে আলাদা স্বাদের। একইসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তোমার ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে বাধ্য করবে এই পাঁচটি বই।
 |
Babli by Buddhadeb Guha |
প্রথম যে বইটি উল্লেখ করবো তা হল বুদ্ধদেব গুহ রচিত বাবলি। এটি আদতে একটি প্রেমের উপন্যাস। খুব ঝরঝরে লেখনী। যারা বাংলা লেখা পড়তে শুরু করেছো তাদের একেবারেই পড়তে অসুবিধা হবে না। আর প্রেমের উপন্যাস তো আমাদের সবার প্রিয়। বুদ্ধদেব গুহের লেখার বৈশিষ্ট্য তিনি প্রকৃতিকে নিয়ে অসাধারণ বর্ণনা দেন। যা তার লেখাকে আরও বেশি ফুটিয়ে তোলে। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখায়। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝতে সাহায্য করেন। যদিও তার বেশিরভাগ উপন্যাসের নায়িকারা হয় বিশিষ্ট সুন্দরী। তাদের চোখ মুখ নাক জুড়ে থাকে সৌন্দর্যের আভাস। কিন্তু বাবলি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বাবলি কিন্তু একেবারেই তার উল্টো। সে একটু মোটাসোটা এবং তার নাক মুখ চোখেও বিশেষ আকর্ষণ নেই। মধ্যাকথা আমারা বাহ্যিক সৌন্দর্য্যকে যেসব মাপকাঠিতে মাপি, সেই মাপকাঠিতে বাবলি বেশ অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও তার মনের সৌন্দর্যে সে একরকম হাজারো সুন্দরী নারীকে ছাড়িয়ে যায়। আর অন্যদিকে আমাদের নায়ক অভি একেবারেই সিনেমার নায়কের মতো হ্যান্ডসাম, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। এছাড়া সে ভালো ক্রিকেট খেলে, ভালো ইংরেজি গান গায়। ভালো নাচে। আবার কবিতাও লেখে। এরকম দুটো মানুষ কীভাবে একে অপরের প্রেমে পড়ে এবং কীভাবে ভালোবাসায় বাহ্যিক সৌন্দর্য্যকে উপেক্ষা করে শুধু মনের মিলকে প্রাধান্য দেয় তা এই গল্পে বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে ।
 |
Ishwar Jokhon Bondi by Debarati Mukhopadhyay |
দ্বিতীয় বইটি হল দেবারতি মুখোপাধ্যায় রচিত রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের প্রথম উপন্যাস ঈশ্বর যখন বন্দি। এটি মূলত একটি অতিপ্রাকৃত থ্রিলার উপন্যাস। রুদ্র প্রিয়ম দুজন সদ্য বিবাহিত দম্পতি। রুদ্রর কর্মসুবাদে এক জমিদার বাড়িতে সে আবিষ্কার করে এক রহস্যময় চিত্র। এখান থেকেই রহস্যের সূত্রপাত। প্রথমে কলকাতা এবং পরবর্তীতে ভূটানের পটভূমিতে ঘটে চলে একের পর এক রোমহর্ষক ঘটনা। আট বছর আগে রুদ্রর বাবা অন্তর্ধানের সঙ্গে এই চিত্রের কোন সংযোগ আছে কিনা সেই রহস্যের উদঘাটন কীভাবে করবে রুদ্রাণী ওরফে রুদ্র? খুবই ফাস্ট পেস এবং উন পুট ডাউনলেবল একটি থ্রিলার উপন্যাস। আমার বই পড়ার যাত্রাও শুরু করেছিলাম এই বইটি দিয়ে। যতক্ষণ না রহস্যের জাল ছাড়িয়ে সত্যি উন্মোচিত হয় ততক্ষণ স্থির হয়ে থাকা যায় না। এক নাগাড়ে one sitting এ পড়ে ফেলার মতো একটি বই।
 |
Tara Bhora Akasher Niche By Srijato |
তৃতীয় বইটি শ্রীজাতের লেখা উপন্যাস তারাভরা আকাশের নীচে। শ্রীজাত মূলত কবিতা লিখলেও তার এই উপন্যাসটি দিয়ে খুব সহজেই বাংলা বই পড়ার যাত্রা শুরু করা যেতেই পারে। এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই একটি ছবি আমরা লক্ষ্য করে থাকি এবং অনেকের পছন্দের একটি পেন্টিং সেটি। 'দ্য স্টারি নাইট'। যারা আর্ট বা পেন্টিং নিয়ে একটু ওয়াকিবহাল তারা এই পেন্টিং সৃষ্টিকর্তাকে ভালোভাবে চেনেন। ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। কিন্তু এই বিখ্যাত পেইন্টারের জীবিত কালীন অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিল না। তার সৃষ্টিকর্মগুলোও এতটা বিখ্যাত ছিল না। এই উপন্যাসের পটভূমি ১৮৮৮ সালের ফ্রান্স এবং সমান্তরালভাবে ২০১৭ সালের কলকাতা। উপন্যাসটির মধ্যে দিয়ে লেখক ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবিত কালীন সময় এবং কলকাতার যুবক ঋত্বিক, যে পেশায় একজন বিজ্ঞাপন জগতের কর্মী হলেও একজন ব্যর্থ আঁকিয়ে তাদের দুজনের জীবনের ডিপ্রেশন, হতাশাকে তুলে ধরেন। এক হ্যালুসিনেশন এবং ইলিউশনের পৃথিবী গড়ে তুলো তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। ঋত্বিককে বুঁদ করে রাখে ভিনসেন্টের অবিস্মরণীয় ক্যানভাস 'দ্য স্টারি নাইট'।
 |
Snehojal by Indranil Sanyal |
চতুর্থ বইটি ইন্দ্রনীল সান্যালের বিখ্যাত মেডিকেল থ্রিলার স্নেহজাল। কলকাতা শহরের একের পর এক খুনের ঘটনা। নৃশংস সেই খুন। কিচেন নাইফ নিয়ে মৃতদেহের পেট কেটে তাতে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে ফুটন্ত তেল। এই রহস্যের সমাধান করতে আসেন কলকাতা পুলিশের চিনার মিত্র এবং ফরেনসিক সাইকায়াট্রিস্ট মোহর চ্যাটার্জি। রহস্যের জাল ছাড়াতে ছাড়াতেই কী তারা প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়বে? অবশেষে কী খুঁজে পাবে আততায়ীকে? এই রহস্য উদঘাটন করতে অবশ্যই এই বই পড়ে ফেলতে হবে। গল্পের নামের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে আছে উত্তর। যারা পড়া শুরু করছো তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই। একেবারেই তোমাকে বোর হতে দেবে না। এবং শেষের টুইস্টা একেবারে হতভম্ব করে দেবে তোমাদের।
 |
Pata Jhorar Morshume by Smaranjit Chakraborty |
পঞ্চম এবং শেষ বই স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর পাতাঝরার মরশুমে। বছরটা ২০০৫ কি ৬। সবে মাধ্যমিকের গন্ডিটা পেরিয়ে বড়ো হওয়ার দিকে এক পা বাড়িয়েছ। নতুন টিউশন ব্যাচ। নতুন মুখ। খাতার পিছনে প্রিয় মানুষের নাম বা তার নাম নিয়ে FLAME খেলা। শরতের পাতার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তুমি ভাবো সে অর্থাৎ তোমার প্রিয় মানুষটি তোমার কথা ভাবছে কিনা। স্বরসতী পূজাতে শাড়ি পাঞ্জাবিতে অঞ্জলী দিতে যাওয়া। আর চোখে তাকে লক্ষ্য করা বা আবার ধরো সেই স্কুলের পিরিয়ড বাংক করে বন্ধুদের সাথে হইহই করে দুই স্কুলের রেষারেষি ফুটবল ম্যাচ দেখতে চলে যাওয়া। যারা এই early 2000 এ স্কুল লাইফ কাটিয়েছো তারা কিন্তু ইতিমধ্যেই আমার কথা শুনে নস্টালজিয়াতে ডুবেছ। স্কুল জীবন, প্রেম বিরহ, মফস্ফলে ফেলে আসা ছোটোবেলাটা যদি আবার বাঁচতে/ অনুভব করতে চাও, তাহলে এক্ষুনি পড়ে ফেল স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর পাতাঝরার মরশুমে।
প্রত্যেকটি বই একেবারেই আলাদা আলাদা স্বাদের। যা তোমাকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে প্রত্যক্ষ করতে সাহায্য করে। বইগুলোতে লেখার ভাষা সহজ সরল হলেও অনুভূতিগুলো কিন্তু বেশ গাঢ়। যার রেশ বইগুলো পড়া শেষ হওয়ার পরের তোমার মননে থেকে যাবে। বই পড়ার শুরুর দিকের বই গুলো আমাদের কাছে বেশ স্পেশাল হয় এবং সেই অনুভূতিটাকে আরও স্পেশাল করার জন্য এই পাঁচটি বই একান্ত উপযোগী।